"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা"এই বিখ্যাত কবিতার লাইনটির সৃষ্টিকারক হল জীবনানন্দ দাশ। আজ আমরা জীবনানন্দ দাশের এই বিখ্যাত লাইন এবং জীবনানন্দ দাশের জীবনী এবং এ লাইনের সকল অর্থ সমূহ খুঁজে বের করব। আশা করি আপনি পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়বেন।
" চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাকিব হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তার অন্ধকারে, বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখি নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন"
কবি জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার মধ্য বিশেষ যে লাইনটি হল চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। কবিতার এই অংশের লাইনে এমন কিছু বিশেষ অর্থ লুকিয়ে রয়েছে যা সবাই এ লাইনে অর্থটিকে সঠিকভাবে জানতে চাই। আসলে কবি জীবনানন্দ দাশ এই কবিতার এই লাইনে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন। আশা করি এই পোস্টে আপনি সম্পূর্ণ পড়লে এই লাইনের সম্পূর্ণ অর্থ এবং সকল তথ্য পাবেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা অর্থ সমূহ
কবি জীবনানন্দ দাশ এর বিখ্যাত একটি কবিতা নাম হল বনলতা সেন। এই কবিতার একটি বিশেষ লাইন সবাইকে অজানা কিছু জানার উৎসাহ জাগিয়েছে। সেই লাইনটি হল "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা"। বনলতা সেন কবিতার এই লাইনে "বিদিশার নিশা" এর সাথে কবি বনলতার নিকষ ঘন কালো চুলের সাথে তুলনা করেছেন। এই লাইনের বিদিশা হলো একটি প্রাচীন শহরের নাম। সেই শহরে অন্ধকার রাতের মতনই এই কবিতার নায়িকার রেশমি কেশ কালো চুল।
কিন্তু এখানে কবি কিভাবে জানলেন যে বিদিশা শহরের রাত এত কালো? আর কেনই বা কবি এই শহরের রাতের সাথে বনলতার চুলের তুলনা করেছেন। সাধারণত জীবনানন্দ দাশ এই শহরের নামটি পেয়েছিলেন সাংস্কৃত ভাষায় লেখা কালিদাসের "মেঘদূত" কাব্যগ্রন্থ থেকে। যেখানে বিদিশার কথাটি উল্লেখ এবং বিস্তারিত বলা রয়েছে। আর এখানে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে কবি জীবনানন্দ দাশ তার স্কুল জীবন থেকেই সংস্কৃত ভাষায় এই কাব্যগ্রন্থটি পড়ে এসেছেন।
এই কাব্যগ্রন্থের একটি লাইন হল "সকল উপচারের কামুক বৃত্তির পূর্ণ ফল" (বৃদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)। বিদিশা মূলত দশার্ণ দেশের রাজধানীর ছিল। এবং শোনা গিয়েছিল সেই কালের এ নগরটি ছিল পাপাচারের একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু। তারপর এটাও জানা যায় যে পেশাদার গণিকাবৃত্তিতে এই শহরের নাম করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেই এই নগরটিতে চঞ্চল হয়ে উঠতো এবং বারবনিতাদের নিয়ে পুরুষরা লাগামহীন নির্যাতনে মেতে উঠত। বিদিশা নিশায় সেই বেশ্যাদের দেহ হতে ভেসে আসতো পরিমলের গন্ধ। পরিমল বলতে এখানে মদ বা নেশা জাতীয় জিনিসের সম্পর্কে বলা হয়েছে।
বনলতাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। অর্থ্যাৎ, বিদিশা নগরের নিশিকালে বেশ্যাদের দেহ হতে যে গন্ধ ভেসে আসতো, তেমনি গন্ধ বনলতার চুলে। মানে দাঁড়ায়, পাপাচারে লিপ্ত নগরীর সাথে তুলনা করতেই শুধুমাত্র কালো চুলের কথা বলা হয়নি, বেশ্যাবৃত্তির সাথে এর বেশ যোগসাজশ রয়েছে।
অনেক গবেষকের দ্বিমত সত্ত্বেও, এর থেকে বহু গবেষক অনুমান করেন, বনলতা সেন কবির দুর-সম্পর্কের বোন ছিলেন না, ছিলেন মূলত গণিকা যার কাছে গিয়ে কবি "দুদণ্ড শান্তি" পেয়েছেন বলে কবিতায় উল্লেখ করেছেন।
এই তথ্যগুলো আমি পেয়েছিলাম ডঃ আকবর আলি খানের "চাবিকাঠির খোঁজে- নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন" বই থেকে।
বনলতা সেন কার ছদ্মনাম?
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ নামটি আলোচিত হয় ১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশের পর থেকেই।১ যদিও ‘বনলতা’ নামটি আছে ১৯৩৩ সালে রচিত তাঁর ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে। সেখানে গল্পের নায়ক (বস্তুত জীবনানন্দের সব গল্প-উপন্যাসের নায়ক তিনি নিজেই) বলছেন, কিশোরবেলায় তিনি যে কালো মেয়েটিকে ভালোবাসতেন, বহুদিন আগে তাকে হারিয়েছেন।
সেই মেয়ের বর্ণনাও ‘বনলতা সেন’ কবিতায় বর্ণিত নারীর মতোই—‘নক্ষত্রমাখা রাত্রির কালো দিঘির জলে চিতল হরিণীর প্রতিবিম্বের মতো রূপ তার; মিষ্টি ক্লান্ত অশ্রুমাখা চোখ, নগ্ন শীতল নিরাবরণ দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট।
জীবনানন্দ জানাচ্ছেন, তাদের পাশের বাড়িতে থাকতো সেই মেয়ে। কবিতার বনলতা সেনের গায়ের রঙ তিনি উল্লেখ করেননি। কিন্তু উপন্যাসের বনলতার গায়ের রঙ বলছেন কালো। কবিতার বনলতার চুলকে বলছেন ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার’; মুখকে বলেছেন ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। আবার কবিতার বনলতার সাথে তার দেখা অন্ধকারে। ফলে তার গায়ের রঙ সেখানে মুখ্য নয়।
‘বনলতা সেন’ আসলে কে ছিলেন?
মূলত আবু তাহের মজুমদার তার নিজের ব্যাখ্যা বলেছেন , বনলতা সেন আসলে বরিশালের ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাঁর বর্ণনা জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসে রয়েছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের পাশের বাড়ির একজন নারী।জীবনানন্দ দাস সেই নারী নিয়ে যে উক্তিটি করেছেন "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা"।
আবু তাহের মজুমদারের এ-লেখার পর আকবর আলি খান আবার কলম ধরেন। এবার ছোটখাট নয়, বিশদভাবে, আগের চেয়ে শানিত কলমে তিনি তাঁর লেখা অন্ধকারের উৎস হতে বইতে “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো : নতুন আলোকে বনলতা সেন”-এর মাধ্যমে মোঃ আবু তাহের মজুমদারের যুক্তিগুলো যে ভুল, তিনিই যে সঠিক সেটি পুণরায় পুরনো সেই অনুমাননির্ভর যুক্তি এবং নতুন আরও কিছু যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন।
পূর্বের বক্তব্য সেই একই, অর্থাৎ, বনলতা সেন একজন বারবণিতা এবং দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে জীবনানন্দ তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। নতুন অনুধাবনগুলো আরও বিভ্রান্তিকর। এ-বার তিনি বনলতা সেন কবিতার তাৎপর্যভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আমরা যাব না। সেটি উদ্ভট এবং সময় নষ্টকারী। কবিতা পড়ে সেটির রস গ্রহণ করাই পাঠকের দায়িত্ব। অপরের মুখে ঝাল খেয়ে কবিতা বুঝতে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। সেই লেখায় তিনি অন্য যারা এই কবিতা নিয়ে নানান অনুধাবন রেখে গেছেন সেটিরও সমালোচনা করেন। মোটকথা, তিনি যা বলেছেন সেটিই সঠিক। বাকীদের পঠন এবং গবেষণার কোনো মূল্য নেই।
জীবনানন্দ দাস এর জীবনী কাল
জীবনানন্দ দাশ-এর লেখা সুবিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতার বিখ্যাত লাইন "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা"। জীবনানন্দ দাশ (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল - ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ - ৫ কার্তিক, ১৩৬১) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তাঁকে বাংলাভাষার "শুদ্ধতম কবি" বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
কবিতা প্রেমিরা জীবনানন্দ দাশের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’ শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।তবে ২০২০ সালে এসে আজ নাটোরের সেই বনলতা সেনকে নিয়ে কথা হচ্ছে না। আজ বলা হচ্ছে নীলাংশী প্যাটেলের কথা। যার চুলে দিশা হারিয়েছে বিশ্ব।
বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা চুল নিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে নাম লেখিয়েছে ভারতের গুজরাট রাজ্যের নীলাংশী। যদিও অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা চুলের রেকর্ড আগে তার দখলেই ছিল। সেই রেকর্ড আরো মজবুত করে নিল ১৭ বছর বয়সী কিশোরী নীলাংশী। বলা ভালো, চুলের মতো রেকর্ডটা তিনি আরো লম্বা করে নিল।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কিশোরীর চুলের দৈর্ঘ্য এখন ১৯০ সেন্টিমিটার বা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম উঠেছিল আগেই। ২০১৮ সালেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সব থেকে লম্বা চুলের রেকর্ড দখল করে নীলাংশী। তখন তার চুলের দৈর্ঘ্য ছিল ১৭০ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট।
নতুন রেকর্ড তৈরির পর নীলাংশী সংবাদমাধ্যমকে বলে, ‘আমি আমার চুল ভীষণ ভালোবাসি। আমি কোনো দিন আমার চুল কাটতে চাইতাম না। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল একদিন আমার নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে লেখা হবে।’
নীলাংশী আরো বলে, ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে নাম লেখাতে পেরে আমি খুবই খুশি। এটা আমার জীবনের নতুন অধ্যায়। পুরো বিশ্ব আমাকে চিনতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় নীলাংশী। তার পড়াশোনার ক্ষেত্রে এত লম্বা চুল কখনো বাধা হয়নি বলে জানিয়েছে সে। যখন তার মা চুলে তেল মাখান বা জট ছাড়াতে বসেন, নীলাংশীর হাতে বই থাকে। নিজের মতো পড়া চালিয়ে যেতে থাকে নীলাংশী। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস। নীলাংশী এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শেষ কথা
আশা করি "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা" জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার এই লাইনটির অর্থ সহ সকল তথ্য আপনাদের দিতে পেরেছি।